কথাটা আশ্চর্য শোনালেও এটাই বাস্তব। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে ৠকবেদের সময় থেকেই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র অত্যন্ত শক্তিশালী ও গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হিসাবে বিবেচিত হয়েছে। শুধুমাত্র ৠকবেদই নয় শিব পুরান মার্কেন্ডয় পুরাণ সহ বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের আশ্চর্যজনক নানা গুনকীর্তন লক্ষ্য করা যায়। দেবাদিদেব মহাদেবকে তুষ্ট করবার এইটিই সবথেকে সহজ উপায়। তাই আর দেরী না করে এই শ্রাবণ মাস থেকেই নিয়ম মেনে শুরু করুন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠ। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র নিয়মিত পাঠের মাধ্যমে মৃত্যুভয় সহ নানা বিপদ থেকে মুক্ত হোন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র ওম্ ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবর্ধনম্। উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মাঽমৃতাৎ।। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র বাংলা অর্থ আমরা ভগবান শিবের উপাসনা করি, যাঁর ত্রিনেত্র রয়েছে, যিনি প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে শক্তির সঞ্চার করে এবং সমগ্র সৃষ্টিকে লালন-পালন করেন। এই মন্ত্রটি আমাদের শক্তি যোগায় এবং জীবনে সুখ, আনন্দ ও শান্তির অনুভূতি প্রদান করে। আমরা প্রত্যেকেই জানি যে অমরত্ব অর্জন করা সম্ভব নয়, তবে ভোলানাথ তাঁর শক্তি দিয়ে আমাদের মৃত্যুর সময়কে কিছু সময়ের জন্য পিছিয়ে দিতে পারেন। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের গুরুত্ব মহামৃত্যুঞ্জয় অর্থান মাহান মৃত্যুঞ্জয়ী মন্ত্র। এই মন্ত্রপাঠের মাধ্যমে মৃত্যু ভয় যেমন দূর হয় তেমনি সর্বরোগ থেকে আপনি ও আপনার পরিবার সুরক্ষিত থাকতে পারেন। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের অলৌকিক ইতিহাস পৌরাণিক কথা অনুযায়ী মহর্ষি মৃকন্ডু এবং তাঁর পত্নী মরুদবতী পুত্রহীন ছিলেন। পূত্র লাভ করবার জন্য তাঁরা মহাদেবের তপস্যা করেন এবং মহাদেবকে সন্তুষ্ট করে এক পুত্র লাভ করেন যার নাম হলো মার্কণ্ডেয়। কিন্তু মার্কণ্ডেয়ের বাল্যকালেই মৃত্যুযোগ ছিল। মৃত্যুযোগ কাটাতে বালক মার্কন্ডেয় অভিজ্ঞ ঋষিদের পরামর্শে শিবলিঙ্গের সামনে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে লাগলেন।মৃত্যুর সময় উপস্থিত হলে যমরাজ এলেন। মার্কণ্ডেয় যমরাজকে দেখে জোরে জোরে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করতে করতে শিবলিঙ্গকে জড়িয়ে ধরেন। যম মার্কণ্ডেয়কে শিবলিঙ্গ থেকে আলাদা করার চেষ্টা করেন। এতে শিব ক্ষুব্ধ হয়ে যান এবং যমকে মৃত্যুদণ্ড দান করেন। ভীত যম তখন শিবকে বলেন যে, আমি আপনারই সেবক, প্রাণীর প্রাণ হরণের নিষ্ঠুর কাজ আপনি আমাকে দিয়েছেন।ক্ষোভ শান্ত হলে শিব বলেন, আমি আমার ভক্তের ভক্তিতে প্রসন্ন। এঁকে আমি দীর্ঘায়ুর বরদান দিলাম। তুমি এঁকে নিয়ে যেতে পার না। মার্কণ্ডেয় জীবিত থাকবে এই শর্তে শিব যমকে অভিশাপ মুক্ত করেন। এর পর যমরাজ বলেন, প্রভু আপনার আজ্ঞা সর্বোপরি। আমি আপনার ভক্ত মার্কণ্ডেয় রচিত মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র যে পাঠ করবে, তাঁকে কষ্ট দেব না। মহাকালের আশীর্বাদে মার্কণ্ডেয় দীর্ঘায়ু লাভ করেন। তখন থেকেই এই মন্ত্রের উৎপত্তি হয়। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব হিন্দু ধর্মের অন্যান্য নানা মন্ত্রের মতই মহামত্যুঞ্জয় মন্ত্রের যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব আছে। প্রতিটি শব্দের ধ্বনিতে শরীরে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্ট হয়। ওম-এর উচ্চারণে ব্যক্তি গভীর শ্বাস নেয়, এর ফলে তাঁর শরীরের বিশেষ অংশ এবং নাড়িতে বিশেষ ধরনের কম্পন হয়। এই কম্পনের ফলে শরীরে উচ্চস্তরের বিদ্যুৎ প্রবাহ উৎপন্ন হয়। শরীরের এই কম্পন ধমনীতে রক্তের প্রবাহ বৃদ্ধি করে। এর ফলে ব্যক্তির রোগ প্রতিরোধক ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করলে শরীরে উপস্থিত সপ্তচক্রে শক্তির সঞ্চার হয়। যে স্বয়ং এই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করে শুধু সে-ই নয়, বরং এই মন্ত্র শুনলেও শরীরে রক্তের সঞ্চার বৃদ্ধি পায়। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্রের প্রতিটি অক্ষরের ধ্বনিতে শরীরের ভিতর যে কম্পন উৎপন্ন হয় তা শরীর কে নীরোগ রাখতে সাহায্য করে। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের আশ্চর্যজনক ফলাফল এই মন্ত্র জপ করলে দীর্ঘায়ু, আরোগ্য, যশ ও সন্তান লাভ করা যায়। এই মন্ত্রটি আমাদের প্রাণে শক্তি যোগায় এবং জীবনে সুখ, আনন্দ ও শান্তির অনুভূতি প্রদান করে। যেকোনও রোগ বা রোগের নেতিবাচক প্রভাবগুলি দূর হয়। কঠিন রোগ এবং অকাল মৃত্যু থেকে মানুষকে রক্ষা করে। কোষ্ঠীতে থাকা নানান দোষ কেটে যায়। পারিবারিক কলহ, ধন-সম্পত্তি সম্পর্কিত যেকোনও সমস্যার সমাধান হয়। কখন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করবেন ১. নিজের বা পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য দুর্বল হলে মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করা উচিত। ২. কাজে লাগাতার বাধা এলে, তা দূর করার জন্য এই মন্ত্র জপ করা হয়। ৩. নতুন গৃহ নির্মাণ করালে মহামৃত্যুঞ্জয় পাঠের জপ করানো শুভ মনে করা হয়। ৪. কোষ্ঠিতে কোনও গ্রহ দোষ নিবারণের জন্য। ৫. মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করলে শোক ও মৃত্যুতুল্য সঙ্কট দূর হয়। ৬. নানান ধরনের ভয় সমাপ্ত করার জন্য। মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র পাঠের সময় যে সকল সাবধানতা মানতে হবে ১. এই মন্ত্র জপ করার সময় এর উচ্চারণের শুদ্ধতা লক্ষ্য রাখবেন। ২. মালার সাহায্যে জপ করবেন। প্রতিদিন অন্তত পক্ষে একমালা জপ পূর্ণ করুন।না হলে অন্তত পাঁচবার ৩. অন্য দিন জপ করে থাকলে প্রথম দিনের তুলনায় কম জপ করবেন না। তার চেয়ে বেশি যত ইচ্ছা জপ করা যায়। ৪. কম স্বরে ধীরে ধীরে মন্ত্র জপ করুন। ৫. রুদ্রাক্ষের মালাতেই মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ করবেন। ৬. জপ করার সময় মালাকে গৌমুখীতে ঢেকে রাখুন। ৭. মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র জপ এবং পূজার্চনার সময় নিজের মুখ পূর্ব দিকে রাখুন। ৮. কুশের আসনে বসে মন্ত্র জপ করা উচিত। ৯. এই মন্ত্র জপের সময় শিবের প্রতিমা, ছবি, শিবলিঙ্গ বা মহামৃত্যুঞ্জয় যন্ত্রের মধ্যে যে কোনও একটি নিজের কাছে রাখুন। ১০. মনে একাগ্রতা রাখুন। জপ করার জন্য একটি শান্ত স্থান বেছে নিন। ১১. শিবলিঙ্গের পাশে বসে জপ করে থাকলে জল বা দুধ দিয়ে অভিষেক করুন। ১২. জপের আগে শিবের সামনে ধূপকাঠি ও প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করুন। লক্ষ্য রাখবেন জপের সময় যাতে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত থাকে। ১৩. ঈশ্বরে আন্তরিক মনোনিবেশ করুন। জপ করার সময় হাই তুলবেন না এবং আলস্য করবেন না। ১৪. জপের দিন ব্রহ্মচর্য পালন করুন। ১৫. যতদিন জপ করবেন ততদিন তামসিক ভোজন যেমন- মাছ, মাংস, রসুন, পেঁয়াজ খাবেন না। আবার মদ্যপান করবেন না বা অন্য কোনও নেশার জিনিস খাবেন না। ১৬. জপের মাঝখানে কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। উপসংহার মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র স্বয়ং শিবের মন্ত্র। এই মন্ত্রে দেবাদিদেবমহাদেব সন্তুষ্ট হন এবং মৃত্যু ভয় সহ নানান বিপদ থেকে নিস্কৃতি দান করেন। সোমবার শিবের বার। তাই দেরী না করে অআগামী সোমবার থেকেই নিয়মিত পাঠ করুন মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র এবং নিজেকে ও পরিবারের সকলকে সুরক্ষিত রাখুন।